ওয়াহিদ সুজন এর ছোটগল্প: কানা খিজিরের আমলনামা


এক.
ময়নাটার নাম খিজিরআমার মায়ের পোষা ময়নামহাপুরুষ খোয়াইজ খিজিরের নামে নামযে কয়েকজন মানুষ কেয়ামত তক বেচে থাকবেন- হযরত খিজির তাদের একজনকেন পাখিটার এই নাম রাখা হয়েছিলো আমাদের পরিবারের কারো ইয়াদ নাইএমনকি মাও জানতেন নাতার প্রাণ ভোমরা ছিলো বয়সের গাছ-পাথরহীন এই পাখিটিখিজিরের আসল মালিক ছিলেন মার কোন এক পর দাদাতিনি নাকি কোন এক কামেল দরবেশের মুরিদান হাসিল করে এই পাখিটির মালিক হন
মা তার বিয়েতে খিজিরকে উপহার হিশেবে পেয়েছিলেন ময়নাটা ছিলো অন্ধগম্ভীর ও ভাবুক কিসিমেরকোন ধরনের অসহায়ত্বের লেশ ছিলো না চলন-বলনেযার উদ্দেশ্য বিধেয়ের মারেফত জানার উপায় ছিলো নাসদা রহস্যময়হঠাৎ কোন কোন দিন কর্কশ স্বরে ডেকে ঊঠত, ‘খিডির’,‘খিডিরএছাড়া তার কন্ঠ বেয়ে অন্য কোন স্বর নামত নাএই কর্কশ স্বর দিয়ে যেন সবার কাছ থেকে আলাদা থাকতে চাইত সেকে জানে কেন সে খিজিরকে খিডির বলতআমরা মাঝে মাঝে খাঁচার কাছে গিয়ে খ্যাপাতাম, ‘খিডির’, ‘ও খিডিরপাখিটি আরো গম্ভীর হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতোএমনিতে মা ছাড়া অন্য কেউ তার কাছে গেলে বা ডাকলে সে খুবই বিরক্ত হতোআমরাও বিরক্ত করার সে সুযোগটা নিতামএক রক্তি ময়নার এতো দেমাগ কিসের!

মা ছাড়া অন্য কারো হাতে দেয়া খাবার পর্যন্ত সে খেতো নামার গন্ধটা সে ঠিকই টের পেতআশে পাশে মা আসলেই তার জাদুকরী ডানায় ঢেউ খেলে যেতোজাদুকরী বলছি এই হালে, এই নিয়ে একটা রটনা ছিলো, সে ডানার ঝাপটায় হঠাৎ হঠাৎ নাকি আলোর ঝলকানি খেলে উঠেসে নুরের তজ্জালী যে দেখে তার ভাগ্যের সুরতই নাকি বদলে যায়দূর দুরান্ত থেকে অনেক লোক পাখিটিকে দেখতে আসতলোকে এই ধারণা কই পেলো জানি না, কারণ আমরা কেউ কখনো সেই নুরের তজ্জালী দেখি নাইতবে, এটা ঠিক আমার মার পানভর্তি মুখ সারাদিন আনন্দে ঝলমল করতসংসারের কোন কালিমায় তাকে কখনো স্পর্শ করে নাইতার চেহারার সেই নুরানী আভা আমাদের ঘরময় মেঘের মতো উড়ে বেড়াতআমরা সবাই সেই অচিন মেঘের ভেলায় ভাসতামশুধুমাত্র যেদিন না মা মৃত্যুর ভয়ে কাতর হতেন
মা আমাদের ঘুম পাড়ানোর কালে খোয়াইজ খিজিরের আশ্চর্য সব কাহানী শুনাতেনতিনি বাদশা জুলকারনাইনের সাথে পৃথিবীর শেষতক অভিযানে গিয়েছিলেনসেটা ছিলো সূয্যাস্তের প্রান্তরেসেখানে সূয্য একটা গর্তের মধ্যে ডুব দিলে পৃথিবীতে রাত্রি নেমে আসেসেখানকার কাকেরা জানত কোন ঝর্ণার পানি পান করলে অমরত্ব লাভ করা যায়কাকেরা খিজিরকে সেই ঝর্ণার হদিস দেয়খিজির সে জল পান করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন আবার জীবিত রয়ে গেলেনকেয়ামত তকমার কাছে খিজিরকে নিয়ে আরো কিছু কাহানী শুনেছিলামতার কিছু আপনাদের শুনাবো

জলে তার বসত, জলে তার নানান কারিগরিজলের মানুষেরা সেই কেরামতির খোঁজে ভক্তি নিয়ে খোয়াইজ খিজিরকে ডাকেভক্তি ভরে তার স্মরণ নিলে অনেক অসাধ্য সাধন হয়আমাদের গ্রামে বর্ষাকালে খিজিরের ভেলা ভাসানো হতোতো, এইসব বিশ্বাসের গৌরব আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিলো নাকিন্তু নানা বিপদ-আপদে কেন যেন খিজিরকে মনে পড়তআমার বাবা আবার এমন ভক্তিতে বিরক্ত হনআমার ছোট কাকা তখন সওদাগরী জাহাজের সারেংগিরি করতেনতার কাছে অহরহ এমন কথা শুনতাম- মনে হতো খিজির ছাড়া তার দুনিয়া অচলতিনি বরাবরই ভীতু স্বভাবেরএতো ভীতু মানুষ দরিয়ার মতো ভয়াবহ স্থানে দিশা পায় কেমনে, সেটাই তাজ্জব ব্যাপারতার বিশ্বাস দুনিয়ার তাবৎ জাহাজ চলে খিজিরের ইশারায়

বাবা ছোট কাকাকে বলতেন, ছোট, আওয়াল আখেরের চিন্তা কর- এই ধরাধরিতে কোন কাজ হবে নাকাকা বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসতেনমনে হতো তিনি বাবার নিবুদ্ধিতায় মজা পাচ্ছেনআর গলায় ঝুলানো তাবিজে হাত বুলাতেনআমরা এইসব না বুঝে বেশ মজা পেতামভাবতাম কাকার হাসি খুশি থাকার পেছনেও আরেক খিজিরের কেরামতি আছেকখনো কখনো দুই খিজিরের তুলনা করতামহযরত খিজির দুনিয়ায় অদেখা আর দুনিয়া ময়না খিজিরের অদেখা

কাকা একদিন আমার কথা শুনে বললেন, মিল-অমিলের যে দুনিয়া, সেখানে কে পাখি আর কে মানুষ তার ভেদ চিহৃ কই? এই ভেদ ধরা ক্ষুদ্র বুদ্ধির কাজ নাতবে আমার মনে হয় তোর মা যখন খিজিরের সাথে মিষ্টি করে কথা বলেন, সেই ভেদ উবে যায়
তারপর তিনি হো হো করে বলে উঠেন, কি মুশকিল! বহুত জঠিল বাত হলো
আসলে মুশকিলআমি তার কথার কিছুই বুঝি নাইউঠোনে নেমে দেখি মা খাচার কাছে গিয়ে ডাকছেন, খিজির ও খিজির

খিজির,শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করেঅতি আনন্দে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলে আমরা যেমন করি আর কি
মা আবার বলেন, খিজির- আমার সোনার ময়না পক্ষী
পাখিটা খুশিতে ডানায় শব্দের ঝড় তুলে
এই খাই খাতির দেখে মাকে টিপ্পনি কাটি, মা-সোনার ময়না খিজির তো তোমাকে ছেড়ে যাবে নাতারে খাঁচার ভেতর বন্দী করে রাখার দরকার কি?
মা বলেন, পোষ মানা কিছুরে খাঁচার বাইরে রাখতে নাইতুই আমি কেউই খাঁচার বাইরে নাখাঁচা না থাকলে প্রেম-পিরীতি, মায়া-মহব্বত কিছুই থাকে নাখাঁচা না থাকলে কেমন উদাস উদাস লাগেশুধু উড়াল দিতে ইচ্ছে করেতাই সবাইরে খাঁচার ভেতর থাকতে হয়
আজব সে কথা শুনে বলি, খাঁচা মানে কিসের খাঁচা? আমি তো কোন খাঁচার ভেতর নাই
মা বলেন, এই হলো মায়া মহব্বতের খাঁচাএই খাঁচা চোখে দেখা যায় নাআর খিজিরের খাঁচা তো ওপরের জিনিসএই খাঁচা চাইলে সে ভাঙ্গতে পারেকিন্তু মায়া তারে ভাঙ্গতে দেয় না

আমি সেই মায়ার খাঁচার হিসেব নিকেশ করতামকিন্তু সেই খাঁচা অধরা রয়ে যায়
বাবা কাছে এই কথাটা পেড়েছিলাম, তিনি বলেন, এই হলো তার ভাবের কথাভাবের কথা সবসময় মনে রাখতে নাইযেটা সত্যি সময়ে সে আপনা আপনাই ধরা দেবে

এই অচেনা অজানা ভাব সময়ে সময়ে বড়োই মুশকিলের আনজাম করেযেন কলিজার মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে থাকেতাই কোনটাকে ঠিক আর কোনটাকে বেঠিক বলব, তার উপযুক্ত মওকা সবসময় মিলে কিনা, সেইটা তখনো আমার বুঝের মধ্যে আসে নাইবাবা ভাব বিষয়ে এই বলেই নিরত্তরআর কিছুই বলেন নাবোধহয়, এই মতামতে তার নিজের কোন আস্থা ছিলো নাউল্টো তার কারণ অকারণ সবকিছুকে এই ভাব থেকে আলাদা করা যেতো নাখিজিরের প্রতি তিনি আলগা দরদ দেখাতেনসম্ভবত তিনিই ছিলেন পাখিটার সবচে অপ্রিয় পাত্রকেন,কে জানে?
তিনি যে ব্যাপারটা বুঝেন না,এমন নয়কিন্তু খিজির আর বাবার মাঝে ছিলো আরেক জটিল রসায়নযেটা হাসিল করতে আমার অনেক বছর লেগেছেতিনি হলেন মাপরে কোন এক সময়ে সেই ছদ্ম আদরের কথা তুললে তিনি বলেন, এক জনরে একেক কিসিমে দুনিয়াতে পরিচিত হতে হয়এখানে কে পাখি আর কে মানুষ তার হিসেব রাখা দায়বাহির দেখে সবসময় ভেতর বুঝা যায় না, এই যেমন কোন কোন মানুষের মনে এক কথা আর বাইরে আরেকতারপরও মানুষের অনিচ্ছুক দায়িত্ব বলে কিছু থাকেতুই এখন বুঝবি না

তিনি পাখিটার এই আচরণ অদ্ভুতভাবে মেনে নিতেনযেন এই তার ধৈর্যের পরীক্ষাতিনি বলেন, এই দুনিয়ায় কামিয়াব হতে এন্তেজারের কোন বিকল্প নাইছোট-বড় যাই কিছু হোক ভালোটারে পেতে চাইলে বহুত ধৈর্য ধরতে হয়নইলে কোন কিছেই হাসিল হয় নাসবচে বেশী ধৈর্যের ব্যাপার হলো কারো মন পাওয়াএই যেমন- আশেক হইলেই কামিয়াব হওয়া যায় নামাশুকের মন পাইতে হয়সে মন পাইতেই তো সবকিছুভাব-ভালোবাসা একের বিষয় নয়এটা দুইয়েই হয়

দুই.
হযরত মুসা (আঃ)র ছিলো ধৈর্যের অভাবআল্লাহর সাথে এটা সেটা নিয়া ক্যাচাল পাড়তেনএকবার তিনি মুসাফিরীতে বের হলেন হযরত খিজিরের সাথেখিজির তারে সাবধান করে দিলেন- যদি মুসা ধৈর্য ধারন করতে পারে, তবে যেন তার সাথে মুসাফির হয়মুসা নবী এই শর্তে রাজি হলেনকিন্তু মুসার সেই ধৈর্য আর কই! খিজির একেকটা কাজ করেন, মুসা রেগে যান আর খিজিরের কর্মের ব্যাখ্যা চান

খিজির ভবিষ্যত দেখার গোপন কালাম জানতেনসেই মতে কাজ করতেনমুসার তো সে জ্ঞান ছিলো নাসুতরাং দুনিয়ার এইসব ভেদ আমার মতো মানুষের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ধরবে কেন! কিন্তু লোকে ঐ যে বলে, যার আকেল আছে তার জন্য ইশারা যথেষ্টবাবার ইশারা মতো ধৈর্য ধরতে পারলে একদিন হয়তো অনেক গুঢ় বস্তু জানাও যেতে পারেআমার ভেতর অধৈর্য আর গোয়াড় কেউ ছিলো না, আবার ধৈয্যের কোন ইচ্ছাও ছিলো না- কিন্তু নিয়তির মতো মুক বধির অন্ধ খিজিরের সাথে সাথে আমি নিজেও মুক বধির অন্ধ হয়ে রইলামসে বাইরে অন্ধ আর ভিতরে চক্ষুস্মানতবে আমার মনে হয় মুসার অধৈর্য হওয়াটা তার পয়গম্বরী গায়েবী দুনিয়ার বাইরের জিনিস নাএটাও একধরনের কেরামতিতাই রোজ রোজ খিজিরের খাঁচার আশে পাশে ভিড় করিআছে নানা কৌতুহলনিয়তির মতো অদ্ভুত আকর্ষণে খিজিরের কাছে বারবার ফিরে যেতামকিন্তু আমার ছোট্ট দুনিয়ায় অলৌকিকের কোন পাত্তা নাই

মার আর ময়নাটার ভাব বিনিময়ের কথা বলছিলামমা খাঁচার আশেপাশে গেলেই পাখিটার অদৃশ্য চোখ গজিয়ে উঠত যেনএ যেন অজানা-অচেনা কেউ, আমার মা মরিয়ম বেগম নাযেমনটা বাবা বুঝেছিলেন এমনতর ভাব-ভালোবাসা কারো সাথে তার ছিলো নাহয়তো এই কথাই ঠিক- দুনিয়ার একেক জনের আলাদা ভাবের জানালা একেক জনের জন্য আলাদাভাবে খোলাএকের রহস্য অন্যে ধরতে পারে না

আপাতত খিজিরের আলোচনা থাকএবার মায়ের চরিত্রের অন্য একটা দিক খোলাসা করিসেটা হলো ভবিষ্যত জানাতে তার আগ্রহ ছিলো সীমাহীনমার ঘুম থেকে জেগে উঠার মধ্যে চমৎকারিত্ব ছিলোএকেক দিন একেক খোয়াবের রেশ নিয়ে জেগে উঠতেন
সূয্য উঠলে আমাকে বলতেন, সুরুজ, বাপ খোয়াবনামাটা নিয়ে আয়

খোয়াবনামা কিতাবটা বৈচিত্র্য বস্তুমায়ের প্রতিটি খোয়াবের বর্ণনা খোয়াবনামায় পাওয়া যেতোমার কথা মতো সেটাই হতোএমন কি ময়না বিষয়ক খোয়াবের অর্থও এতে থাকতএইসব জিনিস আবার সরাসরি লেখা থাকে নামা বলতেন, এটা গোপন হয়ে থাকেসেটাকে নমুনা ধরে ধরে খুজে নিতে হয়মা খোয়াবের রহস্য ভেদ করে ভবিষ্যত জানতে চাইতেনখোয়াব নিশ্চয় অতীতের কোন গোপন রহস্যের বয়ান দেয় নাআবার এই খোয়াবনামা নিয়া তার আধাপ্রকাশ্য অস্বস্থি ছিলো
তিনি নিজেই বলতেন, খোয়াব নামা দেখার অভ্যাসটা খারাপপ্রতিটি খোয়াব মানুষকে কিছু না কিছু জানান দিয়ে যায়যার জওয়াব সেই খোয়াব দেখনাওয়ালার জানা আছেসেটা তারে নিজের ভেতর ডুব দিয়া খুজে বের করতে হয়খোয়াবে আরো অনেককিছু আছে, যেগুলো মানুষরে নানান ইশারা দেয়সে ইশারা হইলো অনেক কিছু জানার চাবিকাঠিআবার অনেক খোয়াব মানুষরে বিপথেও নিয়ে যায়

মার অফসোস ছিলো, তিনি ইশারা ধরার বিদ্যা হারিয়ে ফেলেছেনসেইসব ইশারা তার জ্ঞানের বাইরেএই কারণে কোন কোন খোয়াবের আসলি জওয়াবের জায়গায় অন্য জওয়াব মেলততিনি বিভ্রান্ত ও বিরক্ত হতেন
যে খোয়াবনামার ভেতর জীবন রহস্যের নানা পর্দা খোলা হয়- তাকে নিয়ে তিনি বরাবরই সাবধানআমাকে বলতেন, খবরদার, এই কিতাব খুলবি নাতোর জন্য এর মধ্যে কোন জওয়াব নাইতোরটা তোর নিজের ভেতর থেকে খুজে বের করতে হবে
এটা শুনে আমার হাসি পেতোএই যেমন, বাবা হুক্কা টানেন আবার আমাকে নিষেধও করেন

খোয়াবনামা নিয়ে বাবা বলেন,এটা সন্দেহজনক,এরমধ্যে কুফরী কালাম আছেএগুলো বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য ক্ষতিকর
মা নিরত্তর থাকতেনবিশ্বাস কি আর সবসময় লাভ লোকসানের হিশাব নিয়া চলে

সব জওয়াব তো আর সবসময় প্রতারণা করে নামা একবার এক খোয়াবের জওয়াব দেখে দেখে বিষম চুপসে গেলেনকি এমন হলো কেউ না জানলেও খিজির যেন সেটা টের পেয়ে গেলমার সাথে সাথে সে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিলোহঠাৎ হঠাৎ বিষন্ন হাক ছাড়েশুনলেই বুক ধড়পড় করেসেদিন সন্ধ্যায় খবর আসলো নানাজনের শরীর বেগতিকমা, বাবা আর আমি পৌছতে পৌছতে রাতে দশটাততক্ষণে নানাজনের আত্না অন্য জগতে পৌছে গেছেমা একবারও কাঁদলেন নাচারদিন পর বাড়ি ফিরে এলেনএরপর থেকে আমাকে কখনো তাক থেকে খোয়াবনামা নামাতে হয় নাইমাঝে মাঝে লুকিয়ে কিতাবটা তাক থেকে নামিয়ে ছুয়ে দেখতামবহুদিনের অভ্যাসশুধু খুলে দেখতে ইচ্ছে হতোএরমধ্যে কি রহস্যের চাবি আছে! কিন্তু মায়ের কারণে সেই সাধ আর পূরণ হলো না

মা একদিন খোয়াবনামাটি পুকুরে ফেলে দিলেনসেটা তিন দিন পানিতে ভেসে রইলোকেউ কেউ বলে চতুর্থদিনে আকাশে উড়ে গেছেকিন্তু এই খবর বিশ্বাসে কোন জোরালো তদবির পাওয়া যায় নাসেই তৃতীয়দিন রাতে খিজির হঠাৎ ‘‌মাবলে ডেকে উঠলমার মনে হলো নানাজান ডাকছেবাস্তবে নয় খোয়াবেমাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি দৌড়ে খাঁচার কাছে গেলেনএকটা ছায়া নাকি খাচার কাছে থেকে কোথায় মিলিয়ে গেলোমা এই প্রথম তার বাবার জন্য কাঁদলেনপাখিটা অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মার সাথে কান্না জুড়ে দিলো

অবিকল মানুষের মতো কান্নানাকি মানুষেরা পাখির মতো কাঁদেআমিও তাদের সাথে কাঁদতে শুরু করলামকেন কেঁদেছিলাম জানি নাএই প্রথম এবং শেষবার পাখিটাকে কাঁদতে দেখলামতারপর থেকে সেই আবার আগের খিজির

তিন.
হযরত খিজির একবার এক এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেনদেখতে পেলেন রোদে ঝিকঝিক করছে রূপালী নদীর ঢেউনদীর তীরে মানুষের বসবাসকেউ নদীতে মাছ ধরছে, কেউবা ক্ষেতে কাজ করছেএই সুন্দর দৃশ্য দেখে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেনপাঁচশ বছর পর তিনি যখন আবার ঐস্থানে পৌছলেন, দেখলেন সেই নদী আর জনপদের কোন চিহৃ বর্তমান নাইসেখানে নিবিড় জঙ্গলঘুরতে ঘুরতে তিনি এক কাঠুরের দেখা পেলেন
তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই এখানে তো জনবসতি ছিলো, মেলা লোকজন ছিলো- সেটা কই গেল?
কাঠুরে অবাক হয়ে বলল,আপনি ভুল করছেন, এখানে কখনো জনমানুষ্যির বাস ছিলো নাসে আদ্যিকাল থেকে এই জঙ্গল দেখে আসছেন আমার বাপ দাদা আর তাদের দাদার দাদারাআরো পাঁচশ বছর পর যখন তিনি সেই স্থান পৌছলেনদেখলেন জঙ্গলের নাম গন্ধ নাইএটা এখন দিক চিহৃহীন মাঠশুরু আর শেষহীন অতীত-ভবিষ্যতের মতোতিনি এখানে ওখানে ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলেন

এটাই হয়তো দুনিয়ার ইতিহাসআছে আর নাইনাই আর আছেখিজিরের মতো ক্ষমতা আল্লাহ আমাদের দেন নাইতাই হয়তো বিন্দু দেখে বৃত্ত মনে করিআমরা যতটুক দেখি তারচে বিশ্বাস করি বেশীতারচে বেশী জানি বলে দাবী করিরহস্যের ভেতর রহস্যকিন্তু অত অত না জানলেও আমার আপনার জীবনে কি কোন খামতি আছে!
পারস্যের সেই সওদাগরের গল্প মা একদিন বলেছিলেনযার ছিলো একখানা তোতা পাখিকথা কওয়া তোতা পাখিযার বয়স ছিলো চারশত বছরসে অবশ্য ভিন্নকাহিনীএই চারশত বছরে তার একখানা বিদ্যা হাসিল হইছিলোকি করে ছল বলে কৌশলে খাঁচার বদ্ধ দুয়ার খোলা যায়খিজির কখনো পালাইতে চায় নাইতা হলফ করে বলতে পারিএটা কি পক্ষী স্বভাবের ব্যতিক্রম! তাহলে আসল ঘটনাখান কিযা দেখি তাতে এটা নিশ্চিত যে, খিজিরের মন যদি বাইরের দুনিয়া দেখতে উচাটন হতো, মা নিজেই তারে মুক্ত করে দিতেনমা বলেন, ভাবের শেকল, লোহার শেকলের চে বেশী পোক্তযারে ভাব দিয়ে ধরা যায় না, খাঁচা দিয়ে তারে পুষে কি লাভ

এই আর কি বাত! নানার মৃত্যু আর সেই অদ্ভুত ঘটনার একটা ছাপ আমাদের সবার উপরে পড়েকি যেন এক কঠিন ভার সবার কাধে চেপে বসেখিজিরকে নানা কেচ্ছার ডাল-পালা বাড়তে থাকেআমরা যদিও এইসবের পাত্তা দিতাম না- তারপরও সবার আচরণে কেমন যেন শীতল ভাব

সেই বার কাকা অনেকদিন বাইরে ছিলেনতিনি এসে সব কথা শুনলেনশুনে তিনি বলেন, এতে চিন্তার কি আছেএইসব কথাবার্তা যাদের খোরাক তারা কোন না কোনভাবে লালন করে যাবেউপলক্ষ্য দরকার মাত্রআমাদের এই বেঁচে থাকা কোন কিছুর জন্য থামে নাযদি না থামে তাইলে গড়িয়ে চলব কেন!
আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরো বলেন, দুনিয়ার আর জিনিসের মতো, খিজির হইলো সময়ের স্বাক্ষীঅন্যকিছুকে আমরা এতো স্পষ্ট করে কাছাকাছি দেখি নাই, বুঝি নাই, হয়তো তারা নিজেরাই ধরা দেয় নাইতাদের বয়ানও দুনিয়ার বয়ানমানুষ সবকিছু নিজের চোখ দিয়া দেখে নাকিছু কিছু জিনিস অন্যের চোখ দিয়াও দেখতে হয়এর মধ্যে হেকমত আছেআল্লাহ পাক কোন কিছুরে অপদার্থ করে বানায় নাইকি গাছ, কি পাথর সবকিছুর ভেতর কারিগরি দিছেন

আমি এতোসব বুঝি নাই, কিন্তু কপালগুনে আমার জন্ম তো ঠেকানোর সাধ্য ছিলো নাআর সবার মতো কাকার কথা শুনে মাথায় নাড়ায়আমি ভাবি, খিজির হয়তো আমাদেরচে বেশী দেখছেকিন্তু একটা অন্ধ পাখির কি এমন দেখা- যাতে মাঝে মাঝে মনে মতো সে আমাদের চাইতে বেশী বুঝতে পারে! দুনিয়াদারির কি জ্ঞান সে দিতে পারেরহস্য আমার কাছে দিন দিন জমাট হতে থাকে

যদিও অচিরেই কানা খিজির আমাদের ছেড়ে অনেক দূর চলে যাবেআমার মায়ের মুখের হাসিও একসময় ফিরে আসেতখন ধন্ধে পড়িখোলাসা হয় না মা কোন ধাতের মানুষহয়তে এটাই ঠিক, প্রত্যেকের নিয়তি আলাদাআমরা মিছে মিল খুঁজে মরিনানাজান মারা যাবার দুই মাস পর একদিন- সকালে আবিষ্কার হলো খিজির নাইখাঁচার দরোজাও বন্ধ ছিলোএকটা কালো পালক পড়ে ছিলোসে যেন স্বাক্ষী- কেউ একজন এইখানে ছিলোএই নিয়েও নানা কানাকানি হলোনানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হলামশুধুমাত্র মা চুপ ছিলেন

একদিন দুপুরের খাওয়া শেষে মা, বাবা আর আমি পুকুর পাড়ের লিচু গাছটার তলে চাটাইয়ের উপর শুয়ে আছিপান চিবুতে চিবুতে মা বলেন, পক্ষীরে মানুষের মতন করে বুঝতে হবে সেটা কে বলছেমানুষই যে আসলটা জানে সেটাই বা কেমনে বুঝে আসেদুনিয়ার তাবৎ মাকলুকাত আল্লাহর ইবাদত করে, তারে সেজদা করেমানুষ এটা কি নিজের চোখে কখনো দেখছেএটা কি সে মানুষের মতন করেআল্লাহর সাথে কার কেমন সম্পর্ক হবে এটা আল্লাহ ভালো জানেনআমরা বড় জোর এই কুদরতির শোকর গুজার করতে পারি, এইআর দুনিয়ার তাবৎ মাকলুকাত উসিলা হয়েই তো দুনিয়ারে এমনতর বানাইছে- যেমনটা আমরা দেখি
বাবা বলেন, মানলাম সেটা আমরা বুঝি নাকিন্তু এই যে হাশরের দিন মানুষের হিশেবের খাতা খোলা হবে- সেটা তো তামাম মাখলুকাতের মধ্যে শুধু মানুষ আর জ্বিন জাতিরএই দুনিয়া বুঝার একটা দায়িত্ব মানুষের কাঁধে জোয়ালের মতো আটকে আছেএখন কোথায় কি হয়, না হয়- তা কি আল্লাহ জানেন না? তার ক্ষমতা তো অনন্ত অসীম- সেই চিন্তা করলে আল্লাহর তো এতো হিশেবের দরকার নাইতারপরও কেন এই হিশেব নিকাশদুই কান্ধে দুই ফেরেশতার দরকার কিএখানে তার কুদরতের খেলা আছে
মা বলেন, কোনটা দরকার আছে আর কোনটার নাই- সেটা আল্লাহর কারবারএখানে মানুষ কথার বাচালতা ছাড়া আর কোন কারিগরি দেখাতে পারে না
কথার পর কথা চলতেই থাকেএই কথার ভেতর তেমন কোন দুরত্ব থাকে নাতারা যেন দুই ভাষায় একই কথা বলছেনতাদের এই ক্ষমতায় আমি বেশ মুগ্ধ হইমা বা বাবা কেউই খিজিরকে নিয়ে কোন কথা তুলেন নাই

এইসবের ভিতর কানা খিজির কেমনে যুক্ত হয় আমি জানি নাতাকে নিয়ে সে সব রটনা ঘটনা আমার চিন্তার ভেতর গভীর শিকড় গেড়ে বসেছেতার অস্থির মতিগতি আসলে কি দুনিয়ার ঘটন-অঘটনের ইতিহাসমাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে,তার এই অন্ধত্ব সত্য ছিলো না, এর ভেতর গভীর কোন ইশারা আছেনাকি দুনিয়া ভার বইতে গিয়ে নিজেরে অন্ধ করেছেএইটা হয়তো অতিকল্পনাকানা খিজির তুচ্ছ একটা পাখিমানুষের মায়ার বাধনে জড়িয়ে অনেক কিছু পেয়েছে সেকেউ কেউ এইসব কিছুকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেএমনকি আমার মা বা বাবা কেউ কখনো খিজিরকে নিয়ে যে অদ্ভুত রটনা- তার কোন উত্তর দেয় নাইকিন্তু তখন আমার যে বয়স যাকে এখন তুচ্ছ বলছি- পরমুহুর্তে সে আর তুচ্ছ ছিলো না

সেই সময়টা ছিলো আমার জ্ঞান-বুদ্ধির জন্য ভয়ানক সময়লৌকিক-অলৌকিক নানা ভেদ আমাকে তাড়িত করতযেমন- প্রতিনিয়ত ভালো পূণ্য আর সুন্দরের কথা শুনে আসছিযেটারে আমি খারাপ বলি, সেটারে লোকে ভালো জ্ঞানই করেআবার কোন কোন সময় আমার বেলায় তার উল্টা ঘটেসেখানে পক্ষী দুনিয়ার নির্লিপ্ততা অথবা সামান্য ব্যতিক্রমী অন্ধ খিজির কিসের স্বাক্ষী হতে পারেদুনিয়ার এইসব তফাতের ভেদ সে কিভাবে করবে
কাকা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারেনবলতে থাকেন, পাপ পূণ্য এতো সহজ বিষয় নামানুষের চোখের সামনে যখন পর্দা পড়ে, তখন পাপ বলে কিছু থাকে নাকিন্তু একখান পরিহাস থাকে- যেটা তারে বিরামহীনভাবে খামচায়, শান্তি দেয় নাসেটা হলো পাপএই কানা খিজিরের তো কোন পাপ পূন্যের বিষয় ছিলো নাকিন্তু পাপ পূণ্য তারে নিয়ে বিস্তার করতে পারেকেউ যেটাকে বলবে গৌরবের আর কারো কাছে তা কলংকের

রাত আরো গভীর হতে থাকেতিনি আরো বলেন, কানা খিজির হোক আর হযরত খিজির হোক সত্য হইলেই কি- না হইলেই কি, সে সব জিনিস আমরা লালন করি তা তো আমাদের গলায় কর্মফলের মতো ঝুলে আছেআমরা যা বিশ্বাস সেটা তো আবার আমাদের অবিশ্বাসেরই স্বাক্ষীনাইলে একখান পাখিরই বা কি মূল্য অথবা খোয়াবনামার জওয়াব কেমনে সত্য হয়দুনিয়াতে কে কি চায় সেটা হলো আসল কথাকে কি করে তার চেয়ে তার নিয়তই বড় আমলনামাএই পাখিখান আর কিছু না, আমাদের আমলনামাএইটা না থাকলেও কোন সমস্যা নাইআমলনামা অন্য কোনরূপে হাজির হবেআসল কথা হইলো মানুষের দুনিয়ায় আমলনামা দরকারসেটা যার আমলনামা তাকে পূর্ণ করতে হবেনইলে তার দুনিয়া অচল

আমি কাকার দিকে অবাক হয়ে তাকাইকোন দিব্য দৃষ্টি আমায় স্পর্শ করে নাকি এক চোরা স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নেয়আকাশ ভরা নক্ষত্র আমাদের মাথার উপর উকি মারেকথারত কাকার মুখে নক্ষত্রের আলো নানা রকম আকাঁবুকি কাটেতার পেছনে কানা খিজিরের শূণ্য খাঁচায়ও সেই আলোর নির্ঝরনীকানা খিজির যেন মাঝে মাঝে ডানায় শব্দ তুলে নাচছিলকি মনে করে- আমি সেই অদ্ভুত ঝকমকানি দেখার অপেক্ষায় থাকিনা,আমার গলায় ঝুলে থাকা আমলনামার সাথে তার কোন সম্পর্ক নাই

এবার খাঁচাটাও অনেক দূরে কোথাও সরে যায়পাখি নাই,শূণ্য খাঁচাটা নাইকিছুই পড়ে থাকে না

সূত্র:

0 comments:

My Blog List

নন্দন সম্পাদক ইমন রেজার লিংক

©2009 nondon an open platform on Art Literature and Culture.

Back to TOP