আনিসুল হক এর গল্প: যাওয়া


বাবা বললেন, শাহিন, অন্যরা যাচ্ছে যাক, তুই কিন্তু যাবি না
না বাবা, যাব না
অন্যের ছেলেরাও ছেলে অন্য বাবারাও বাবা তবু তোর যাওয়ার দরকার নাই? তুই কী বলিস!
জি, আমিও তা- বলি
আমি কিন্তু আমার কথা ভেবে কথাটা বলছি না তোর মার কথা ভেবে বলছি বুঝিসই তো, মেয়েমানুষ মায়ার শরীর
বাবা, আমি যাচ্ছি না এত বলতে হবে না

মানে তুই কিন্তু ভাবিস না যে আমি একজন স্বার্থপর বাবা মোটেও আমি স্বার্থপর নই কিন্তু তোর মাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না খালি কাঁদবে তার কান্না ভয়াবহ একটুও শব্দ হবে না কিন্তু অনর্গল পানি পড়তে থাকবে চেরাপুঞ্জি হয়ে যাবে বাড়িটা
বাবা, তুমি কথা বলো সুন্দর
তোর মায়ের হয়েছে কি, অনেক ছেলেমেয়ের শখ ছিল মিনিমাম ১১টা ছেলেমেয়ে হলে সে সুখী হতো একটা ফুটবল টিম বানাতে পারত বোধহয় তোর একটা বড় বোন হয়েছিল রে বাঁচল না খুব কান্নাকাটি করত বাড়ির পেছনে তার কবর দেওয়ার কথা তোর দাদা বলল, খবরদার গোরস্থানে দাও এইখানে কবর দেওয়া হলে এই মহিলার কান্না জীবনেও থামবে না তা- করা হলো কিছুদিনের মধ্যেই তুই পেটে চলে এলি ভাগ্যিস এলি কিন্তু তোর জন্মের সময়ই ওর পেটের টিউমার কেটে ফেলে দিতে হলো একটামাত্র ছেলে নিয়েই ওকে থাকতে হলো এইটা চায়নি অনেক ছেলেমেয়ে চেয়েছিল বুঝলি?
জি বাবা বুঝেছি আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান বাবা, এটাকে কী বলে হাতের যষ্টি, না ষষ্টি?
যষ্টিই মনে হয় বলে শোন, আমি কিন্তু অতটা স্বার্থপর না অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের সবার যাওয়া উচিত পাকিগুলোকে বোঝানো দরকার, বাঙালি কাপুরুষ না
না বাবা বন্ধুরা যাচ্ছে, ওরাই বুঝিয়ে দিতে পারবে আমাকে যেতে হবে না
আচ্ছা, তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে তুই ঘুমা
বাবা, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তুমি শোও প্রেসারের ওষুধ খেয়েছ?
হ্যাঁ খেয়েছি
যাও তাহলে, শুয়ে পড়ো
বাবা চলে গেলে শাহিন শুয়ে পড়ল তার চোখে ঘুম নাই সে ভাবল, মনঃসংযোগ করবে বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে এবার সে শুধু ঝিঁঝির ডাক শুনবে অন্য সব শব্দ বাদ দিয়ে সে শুধু ঝিঁঝির শব্দে কান পাতল তারপর সে নিজেকে বলল, শাহিন, শুধু কুকুরের ডাক শেয়ালেরটা না এইবার সে শুধু কুকুরের ডাক শুনছে
দরজায় খুট করে শব্দ হলো তার মন-শাসনে বিঘ্ন ঘটল কে?
আমি! মার গলা ঘুমাসনি?
না ঘুম আসছে না
শোন তোর কিন্তু যুদ্ধে যাবার-টাবার দরকার নাই বুঝছিস?
জি বুঝছি
আসলে তোর বাবার শরীরটা তো তুই জানিসই ব্লাড প্রেসারের রোগী টেনশন সে একদম নিতে পারবে না যদি সকালবেলা উঠে দেখে তোর বিছানা পড়ে আছে তুই নাই, তাহলে নির্ঘাত মাথায় রক্ত উঠে মরে যাবে
না, মারা যাবে না কারণ আমি যাচ্ছি না
তোর বাবার মতো নরম মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই একটা মুরগি তার সামনে জবাই করা যায় না কী করে যে এই জগতে আছে! ঘুমা
আচ্ছা
শোন তুই কিন্তু ভাবিস না আমি স্বার্থপর মা আমি কেন স্বার্থপর হতে যাব সব মা- তার ছেলেকে-মেয়েকে পেটে ধরে অন্যদের ছেলেরা যেমন মায়ের ছেলে, তুইও তেমনি তোকে তো আমি আটকাতে পারি না, তাই না? কিন্তু তোর বাবার কথা ভাবলে আর বলতে পারি না যে যা তুই গেলে লোকটা বাঁচবে না যাস না বাবা বুঝলি?
জি, যাব না
তোর কথায় জোর নাই আমার হাত ধরে বল, যাবি না
দাও, তোমার হাত কত দিন ধরা হয় না! ধরি
বল, যাব না
যাব না
মা ফিরে গেলেন বাবা জেগে বললেন, আছে এখনো?
আছে
জেগে আছে?
হ্যাঁ
যাবে না তুমি ঘুমাও
না, যাবে কেন? তুমি ঘুমাও
পরের দিন ভোরবেলা নামাজ পড়তে উঠলেন মা প্রথমেই উঁকি দিলেন শাহিনের ঘরে না যায়নি গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে গরমের মধ্যে গায়ে চাদর দেওয়ার কী হলো অবশ্য শেষরাতে একটু বৃষ্টিমতো হয়েছে
বাবা উঠলেন তারপর উঁকি দিলেন ছেলের ঘরে জানালা খোলা আসন্ন সকালের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছেলে আছে যায়নি
বাবা বললেন, তোমার জন্যে ছেলেটা আমার যেতে পারল না
মা বললেন, আমার জন্যে হবে কেন, তোমার জন্যে ব্লাড প্রেসারটা সামলাতে পারলা না এত মাংস খেলে কী হবে
রোদ উঠল মা নাশতা বানাচ্ছেন চালের আটার রুটি আর আখের গুড় গরম গরম খেতে হবে•••
ছেলেকে ডাকতে হবে তার ঘরে গেলেন হাতে রুটিবেলা আটা আঁচলটা যাতে হাতে না লাগে, সে জন্যে হাতটা উঁচু করে ধরা বাবা ওঠ বাবা
কাঁথা সরালেন ভেতরে একটা বালিশ আর একটা কোলবালিশ ছেলে চলে গেছে
মা বললেন, শাহিনের বাবা আসো নাশতা খাও
শাহিন উঠল না? বাবা জিজ্ঞেস করলেন
না অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে ঘুমাক তুমি নাশতা খাও
আছে তো?
আছে
তোমার জন্যে যেতে পারল না তোমার জন্যে বাবা থালায় রুটি তুলে নিলেন
-------------------------------------------------------------------------
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮

0 comments:

My Blog List

নন্দন সম্পাদক ইমন রেজার লিংক

©2009 nondon an open platform on Art Literature and Culture.

Back to TOP