রবীন্দ্রনাথকে লেখা অপ্রকাশিত পাঁচ পত্র
১৯২৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত কালপর্বে রবীন্দ্রনাথকে
লেখা খ্যাত-অখ্যাত পাঁচজন কবি যশস্কামের অপ্রকাশিত পাঁচটি চিঠি এখানে গ্রথিত। সাহিত্যিক বিবেচনায় নয়, সামাজিক ঐতিহাসিক গুরুত্বের
পরিপ্রেক্ষিতে আপাততুচ্ছ এসব পত্র বিবেচ্য।
রাজশাহীর হোমিওপ্যাথ ডাক্তার কবি এমএ (মীর
আজিজুর) রহমানের চিঠিতে কবির কাছে প্রার্থনা করা হয়েছিল রহমান সাহেবের প্রকাশিতব্য
মাস্তানা কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পূর্বে প্রদত্ত হারিয়ে যাওয়া অভিমতটি আবার লিখে
দিতে।
কলকাতা মাদ্রাসার শিক্ষক কাজী কাদের নওয়াজ তাঁর উপহার দেওয়া
মরাল কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রতিশ্রুত অভিমত চেয়ে লিখেছেন। মালদহ জেলা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র এ কে এস (পরে আ কা শ) নূর মোহাম্মদ একটি
কবিতা পাঠিয়ে অনুরোধ করেছেন কবি যেন কোনও পত্রিকায় সুপারিশ করে কবিতাটি প্রকাশের ব্যবস্থা
করেন। বগুড়ার স্কুল ছাত্রী সাড়ে এগারো বছর বয়েসী জেব-উন-নেছা (পরে
জেব-উন-নেসা জামাল) রবীন্দ্রনাথকে ‘দাদু’ সম্বোধন করে তার কাঁচা হাতের লেখায় চিঠিতে কবির স্নেহলিপি প্রার্থনা
করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান সমাজের নিম্ন
মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, সাড়ে পাঁচ বছরের শিশু
মামুন মাহমুদ থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হিজ হাইনেস
আগা খান-খাজা নাজিমউদ্দিন, স্যার আজিজুল হক ও
আবদুল গাফফার খান পর্যন্ত অসংখ্য খ্যাত-অখ্যাত মুসলমানের যোগাযোগ ঘটেছিল। পত্রবিনিময়, সাক্ষাৎ-পরিচয়, মুসলমান লেখকদের বইয়ে কবির ভূমিকা ও সমালোচনা, মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্রে শুভেচ্ছাবাণী ও কবির রচনা প্রকাশ, শান্তিনিকেতনে কবির উপস্থিতিতে মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনা-পাঠ,
বিশ্বভারতীতে ইসলামি সংস্কৃতি গবেষণা ও চর্চা, মুসলমান লেখকের বই ও রচনা প্রকাশে কবির সুপারিশ, শান্তিনিকেতনে মুসলমান ব্যক্তিত্বের সংবর্ধনা-অভ্যর্থনা ইত্যাদি
নানা কর্মসূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান সমাজের সম্পর্কের পুরো ও বিস্তৃত খতিয়ান
এখনও তৈরি হয়নি। তবে আমাদের সৌভাগ্য, কবিকে লেখা এসব চিঠিপত্রের একটি বড় অংশ রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায়
সংরক্ষণ করা হয়েছে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পরিচালনার
ভার গ্রহণ করার সময় থেকে কবি প্রেরিত চিঠির সচিব-কৃত অনুলিপি রাখা হতো। শিবনারায়ণ রায় রবীন্দ্রভবনের ডিরেক্টর পদে যোগ দেওয়ার পর বিশ শতকের অষ্টম দশকে
এসব চিঠিপত্র ও কবির জবাবের অনুলিপি পত্রপ্রাপকদের নামের আদ্যাক্ষরের বর্ণনানুক্রমে
স্বতন্ত্র ফাইলবন্দি করে সুশৃঙ্খলভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে সব চিঠি ও জবাব এখনও রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানা সংগ্রহ করতে পারেনি।
এখানে সংকলিত অধিকাংশ উপাদান রবীন্দ্রভবন
মহাফেজখানা থেকে সংগৃহীত। কয়েকটি চিঠির প্রতিলিপি
নানা দুষপ্রাপ্য ও লুপ্ত সাময়িকপত্র থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে।
এসব চিঠি পাঠ করে আমরা উপলব্ধি করতে পারব
রবীন্দ্রনাথ কত ধৈর্যশীল ও সহনশীল ছিলেন। তিনি কোনও কোনও পত্রলেখকের
অসঙ্গত আবদারও রক্ষার চেষ্টা করেছেন তাঁর সহস্র কর্মব্যস্ততার মধ্যে। অবশ্য এমন ভাবাযুক্তিসঙ্গত হবে না যে, মুসলমান বলেই
কবি তাঁদের প্রতি সৌজন্য প্রকাশ করেছেন, তিনি সবার প্রতিই
এমন আচরণ করতেন। তবে মুসলমান পত্রলেখকদের প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ
তৎকালের ভারতবর্ষের বিরাজমান হিন্দু-মুসলমানের জটিল সম্পর্ক বিষয়ে, উভয়পক্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভেদ সম্পর্কে, বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ ব্যবহার বিষয়ে তাঁর অভিমত
অকপটে ব্যক্ত করেছেন। মুসলমানদের সঙ্গে কবির এই যোগাযোগ সবসময় সুখকর
হয়নি। বিশ্বভারতীতে ইসলামি সংস্কৃতি বিভাগের একটি অধ্যাপক পদের ব্যয়
বহনের অনুরোধ জানিয়ে আগা খানের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছিলেন কবি। ধনকুবের আগা খান সৌজন্যবশত জবাব দিলেও শেষ পর্যন্ত সহযোগিতার হাত বাড়াননি,
কবির আহ্বানে উপযুক্ত সাড়া দেননি। বরীন্দ্রনাথ আগা খানের কাছে যে আচরণ পেয়েছিলেন, তাতে অপমানিত বোধ করেছেন বলে নিজেই এক চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করেছিলেন।
দুই
এখানে গ্রথিত পত্রপঞ্চকের প্রথমটির তারিখ
২৪ জুন ১৯২৪। লেখক রাজশাহীর কলেজ রোড নিবাসী হোমিওপ্যাথ
ডাক্তার কবি এম এ (মীর আজিজুর) রহমান। রবীন্দ্রনাথকে লেখা
মুসলমানদের সংরক্ষিত পত্রাবলির মধ্যে এটিই প্রাচীনতম। এর আগে রবীন্দ্রনাথ সারা তৈফুরের (শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নি হুরুন নেসা
সারা খাতুন ১৮৮৮-১৯৭১) স্বর্গের জ্যোতি, একরামউদ্দীনের
রবীন্দ্র-প্রতিভা (১৯১৪) ও এয়াকুব আলী চৌধুরীর নুরনবী (দ্বি-স ১৩২০ বঙ্গাব্দ)- এই তিনটি
বইয়ের সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানিয়েছিলেন। উল্লিখিত তিনজন সম্ভবত
চিঠিসহ বই পাঠিয়ে কবির মতামত প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু এঁদের চিঠি রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত হয়নি। তবে ১৯২২-এর ১২ মে কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের লেকচারার
মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে (পরে ডক্টর) স্বতঃপ্রবৃত হয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদের
(ম্যানেজিং কমিটি, পরে সিন্ডিকেট) সদস্যরূপে বরণ করে চিঠি লিখেছিলেন। ১৯২৪-এ রবীন্দ্রনাথ শহীদুল্লাহর যে চিঠির উত্তর লিখেছিলেন সেই চিঠিটিও রবীন্দ্রভবনে
সংরক্ষিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা মীর আজিজুর রহমানের চিঠির
বিষয়বস্তু কিঞ্চিৎ কৌতুকাবহ। কবি সাহেব শান্তিনিকেতনে
গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে স্বরচিত কাব্যের পান্ডুলিপি থেকে শোনাবার অভিপ্রায়ে। পরে রচিত আত্মজীবনীতে রহমান সাহেব স্মৃতিচারণ করে (অপ্রকাশিত) জানিয়েছেন,
মাস্তানা কাব্যের কবিতা আবৃত্তি শুনে ‘রবীন্দ্রনাথের চক্ষুদ্বয় হতে অঝোরে অশ্রম্নধারা নামিয়া দীর্ঘ
শ্বেত শ্মশ্ররাজি অভিষিক্ত’ হয়েছিল। মাস্তানা কাব্য সম্পর্কে প্রশংসামূলক কিছু লিখে দিয়েছিলেন। সেই প্রশংসাবাণীটি হারিয়ে যায়, ‘অবশ্য তার নকল
রেখেছি’- উল্লেখ করেছেন কবিযশোপ্রার্থী। এবার পত্রাঘাতে লক্ষ করি যদি দয়া করে “তোমার নিজ হাতের
লেখাটা আবার দাও তবে ‘ব্লক’ করে নিতুম।” যাহোক, রবীন্দ্রনাথ আরেকটি সার্টিফিকেট দিলেন। কিন্তু এম এ রহমানের
চিঠির তারিখ ২৪/৬/২৪ আর রবীন্দ্রনাথের চিঠির তারিখ ৩১/১২/৩৮। সম্ভবত এম এ রহমানের তারিখ খ্রিস্টাব্দের আর রবীন্দ্রনাথের বঙ্গাব্দের।
বইটি প্রকাশের পর (১৯৩৯) কবিকে উপহার পাঠানো
হয়েছিল, বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মাস্তানা
ক্যাটালগভুক্ত হয়েছিল (সংখ্যা ৮১ আ ব)।
সূত্র:
http://www.shaptahik2000.com.bd
0 comments:
Post a Comment